স্টাফ রিপোটার:
অর্থ পাচারকে দেশের প্রধান সমস্যা বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেছেন, প্রত্যেক বছর ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের মুদ্রা পাচার হচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে হুন্ডি। রিজার্ভ কমার ক্ষেত্রে এটাও একটি অন্যতম কারণ। অথচ কেন যেন অর্থ পাচারের ব্যাপারে সরকার নীরব। এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) কিছু বলছে না। সব মিলিয়ে দেশের ঋণখেলাপি, কর খেলাপি এবং অর্থ পাচার একই সূত্রে গাথা। বৃহস্পতিবার ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তিকায় তিনি এসব কথা বলেন।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ঋণ পুনঃ পুনঃ পুনঃতফশিল করার কারণে ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এর জন্য বন্ডের মাধ্যমে টাকা ছাপিয়ে অর্থ সরবরাহ করতে হচ্ছে। যার ফলে মূল্যস্ফীতি কমছে না। তাই শক্ত হাতে খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে। এই বিষয়গুলো নীতিনির্ধারকদের বোঝানোর মতো একজন লোক থাকা দরকার।
তিনি বলেন, দেশের সবাই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে। কিন্তু কেউ অনেক বেশি আবার কেউ একেবারেই সামান্য। আগের তুলনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অবক্ষয় হয়েছে সেটার সঙ্গে আমি একমত। বাংলাদেশ ব্যাংকে এখন যা হচ্ছে তা আগে ছিল না বা হতে দেওয়া হয়নি। দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিষয়ে তিনি বলেন, খেলাপিওয়ালারা যদি অনেক বড় হয়ে যায় তাহলে সমস্যা। ১০ হাজার টাকার কৃষি ঋণ নিয়ে খেলাপি হলে তাকে জেলে ঢোকাব, আর ১০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হলে তাকে সালাম দেব, এটা হতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে ঋণগুলো অবশ্যই আদায় করা উচিত।
মল্যস্ফীতির বিষয়ে ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, কিছু অসাধু খাদ্য কর্মকর্তা ও মিল মালিকরা মিলে কারচুপি করছেন। যার ফলে দেশে খাদ্যের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। তাই চাইলেও সরকার খাদ্য মূল্যস্ফীতি বা ফুড ইনফ্লেশন কমাতে পারছে না। এক্ষেত্রে সরকারের গুদামের মজুত বাড়ানো এবং বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশে স্বস্তি ফেরানোর পরামর্শ দেন সাবেক গভর্নর। তিনি বলেন, বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। তাই এখন সরকার আগামী ১৫ দিন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ২০ লাখ টন খাদ্য সংগ্রহ করলে কৃষকরা বাঁচবে এবং ফসলের আসল দাম পাবেন।
সাবেক গভর্নর বলেন, ধনী-গরিবের বৈষম্য আগেও ছিল এখনো রয়েছে। তবে ধনী ও গরিবের মধ্যে অর্থের পার্থক্য আগের তুলনায় বেড়েছে। এই বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থনীতি নয় রাজনৈতিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। তিনি বলেন, একটি দাতা মুরুব্বির পরামর্শ নিয়ে ৯২ সালে স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। এটাই এখন ব্যাংকের বড় সমস্যা। এসব সমস্যার সমাধানের অনেক পথ রয়েছে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত একটি প্রক্রিয়া। তবে এটাই একমাত্র প্রক্রিয়া নয়, আরও বিকল্প রয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাতের সার্বিক সমস্যার সমাধানে ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠন করারও প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়, তেমনি শাখা খোলার অনুমতিও দিয়ে থাকে। সাধারণত দেশে একটি ব্যাংকের শাখা ১৫ হাজার লোকের সেবা দিয়ে থাকে। ভারত ও পাকিস্তানে ১২ হাজার লোকের সেবা দিয়ে থাকে। তাই জনসংখ্যা অনুপাতে ব্যাংকের আরও শাখা হতে পারে।
তিনি বলেন, পৃথিবীর সব দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ তেমনভাবে পারেনি। এজন্য মনিটরিং পদ্ধতি বদল করতে হবে। এটা সরাসরি তদারকি বাড়াতে হবে।
ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, ৯ দশমিক ৭ মূল্যস্ফীতির পরও মানুষ ভালো আছেন বলে মন্ত্রীরা বলছেন। এটা বাস্তবতা বিবর্জিত। হয়তো সামান্য বেতন বেড়েছে, কিন্তু এ মূল্যস্ফীতিতে মানুষ ভালো আছে এটা বলা যাবে না। দেশের সার্বিক অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বিশ্বের যেকটি দেশ জিডিপির ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে একটি। করোনার সময় ১৬ দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ভারসাম্য রক্ষা করে আসছে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মিরধা। সঞ্চালনা করেন ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম। অনুষ্ঠানে অর্থনীতির বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক শওকত হোসেন মাসুমসহ গণমাধ্যম কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।